প্রভাতসঙ্গীতের গীতিকার ও সুরকার শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের জন্ম ইং ১৯২১ সালে, বৈশাখী পূর্ণিমায়। মহাপ্রয়াণ ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর। সশরীরে তিনি পৃথিবীতে ছিলেন ৬৯ বছর। এই ৬৯ বছরের মধ্যে সমাজের জন্যে সুনির্দিষ্টভাবে তাঁর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র ৩৫ বছর। ১৯৫৫ সালে "আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘ"র প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত।
লৌকিক সংসারে যখন কেউ শরীর ছেড়ে চলে যান আমরা তখন নিজেদের মধ্যে পরস্পর বলাবলি করি, ভদ্রলোক সন্তান-সন্ততিদের জন্যে কী রেখে গেলেন। উত্তরে কেউ হয়তো বলেন ভদ্রলোক অঢেল ঐশ্বর্য, বিষয়সম্পত্তি, গাড়ী-বাড়ী সবই রেখে গেছেন। শুণে ভাবি, যাক উত্তরসূরীদের আর কোন অসুবিধা হবে না। আবার অন্য কোন ক্ষেত্রে কেউ যদি বলেন ভদ্রলোক এক কপর্দকও ছেড়ে যাননি, ছেলেমেয়েরা কী কষ্টটাই না করবে। শুণে আমরা দুঃখ পাই। মহা মণীষীদের ব্যাপারে পৃথিবী ভাবে সমাজের জন্যে তাঁর অবদান কতটুকু।
একইভাবে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার আমাদের জন্যে কী রেখে গেছেন। উত্তরটা অতি সহজ না হলেও গভীর আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে এতটকু অবশ্যই বলা যায়, তিনি বিশ্ববাসীর জন্যে কী না রেখে গেছেন, কী না করে গেছেন।
সমাজে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের তিন মূখ্য পরিচিতি--শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তি, ও বাবা। শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার পশ্চিমবঙ্গের বর্দ্ধমান জেলা নিবাসী পরম শ্রদ্ধেয় শ্রীলক্ষ্মীনারায়ণ সরকার ও রত্নগর্ভা শ্রীমতী আভারাণী সরকারের সুপুত্র। এই নামে তিনি পৃথিবী গ্রহের অধিবাসী। এই নামেই তিনি বিশ্ববরেণ্য দার্শনিক, বৈপ্লবিক সমাজ-অর্থনৈতিক দর্শন প্রাউট-এর প্রবক্তা, অভিনব লেখক-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ্, ও নানান নব নব তত্ত্বের মহান উদ্গাতা--বহুমূখী প্রতিভাসম্পন্ন এক অনন্য প্রাজ্ঞ পুরুষ। এই শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারই আট বছরে আটটি ভাষায় রচিত ৫০১৮টি সঙ্গীতসমষ্টি "প্রভাতসঙ্গীত"য়ের অদ্বিতীয় স্রষ্টা।  সঙ্গীতগুলির সুরকারও তিনি স্বয়ং।
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারই গুরুরূপে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি নামে জগতপূজ্য, যোগ ও তন্ত্র নির্ভর বিজ্ঞানভিত্তিক আধ্যাত্মিক সাধনার প্রবর্তক। আবিশ্ব অগণিত ভক্ত-সাধকের আরাধ্য দেবতা। এই নামেই তিনি ত্রিশাস্ত্রের প্রণেতা, নানান অমূল্য ধর্মগ্রন্থের রচয়িতা। আনন্দমার্গ ও আনন্দমার্গ প্রচারক সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠাতা। হাজার হাজার নিবেদিতপ্রাণ সন্ন্যাসী-সন্ন্যাসিনীর ও বিশ্বব্যাপী ভক্তকুলের চোখের মণি, পুরুষোত্তম।
এই পরমারাধ্য গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিই ভক্তশিষ্যের একান্ত আপন পরমপ্রিয় "বাবা"ও। গভীর দর্শনের জটিল তত্ত্বে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারকে হয়তো বা সকলে সহজে না-ও ধরতে পারেন। গুরু হিসেবে গুরু-দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি যে সব নিয়মনিষ্ঠ সাধনপথের নির্দেশ দিয়েছেন সে সব সকলের পক্ষেই যথাযথভাবে অনুসরণ করা সম্ভব। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা বাবা হিসেবে তিনি সব দেশের সব শ্রেণীর সব মানুষের কাছে সহজলভ্য--অতি আপনজন। সকলে তাঁর স্নেহের পরশ পেতে উদ্বাহু।  সমস্ত বাধা নিষেধের বেড়া ভেঙে পরম পিতৃ-স্নেহে তিনি জগদ্বাসীকে বাবা-রূপে ধরা দিয়েছেন।
শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অমূল্য অবদান সম্পর্কে অবহিত হতে গেলে তাঁর তিনটি রূপই জানতে হবে।  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, শ্রীশ্রীআনন্দমূর্তি, ও বাবা -- তিন অভিরূপেই তিনি অনন্য, অদ্বিতীয়--অনুপম, অতুলনীয়। তাঁর প্রজ্ঞাশীল জ্যোতিষ্কণায় ত্রিলোক অভিস্নাত, পারমার্থিক পরিনন্দনে বিশ্বমানস পরিক্লিপ্ত।
মানুষ হিসেবে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার একজন আদর্শ মানব--মহামানব। এক অত্যুজ্জ্বল অনুকরণীয় মানব চরিত্র। অনমনীয় দৃঢ়চেতা আদর্শ পুরুষ। যাঁর জীবনের প্রতিটি পল রত্ন-খচিত। প্রতিটি অভিস্ফূর্ত্তি শিক্ষণীয়, অনুকরণীয়। শিক্ষা-সাহিত্য-সঙ্গীত, কৃষি-বিজ্ঞান-শিল্প, সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি--তাঁর সৃষ্ট প্রতিটি দার্শনিক তত্ত্বই অকাট্য, অভ্রান্ত। যুক্তিশীল প্রজ্ঞা-ঐশ্বর্যে উদ্ভাসিত।
একজন আদর্শ গুরু হিসেবে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি ত্রিতাপদগ্ধ জগদ্বাসীকে শাশ্বত আনন্দ লাভের পরম পথ দেখিয়েছেন। সংকীর্ণ ধর্মমতে দীর্ণ-বিদীর্ণ পৃথিবীকে এক অখণ্ড মানবধর্মের স্বর্ণ সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করার শুভ সূচনা করে গেছেন। সমাজ দেহের অভ্যন্তরে নীরবে-নিভৃতে এক নোতুন প্রাণরস সঞ্চার করে গেছেন। শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি বহুধা-পল্লবিত আনন্দমার্গের একমেবাদ্বিতীয়ম্ রূপকার--ভবসাগরের পরম কর্ণধার।
"বাবা" রূপে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি পরম প্রেমময়--চিরশাশ্বত প্রেমের মূর্ত্ত বিগ্রহ। প্রাণে প্রাণে তিনি অকাতরে অফুরন্ত স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা ঢেলে দিয়ে গেছেন। সবাইকে প্রাণ ঢেলে ভালো বেসেছেন।  এক অচ্ছেদ্য প্রীতির ডোরে বেঁধে দিয়ে গেছেন সবার হৃদয়। সারা বিশ্ব-সংসারকে তিনি অতি জাগতিক নন্দন দোলায় দুলিয়ে দিয়ে গেছেন। এক অনির্বচনীয় দিব্য আনন্দে তিনি মাতিয়ে দিয়ে গেছেন আমাদের সবাইকে। তাঁর অকৃপণ কৃপা-করুণায় ধরিত্রী অভিস্নাত। বাবা সবার প্রাণের প্রিয়। সুখে দুঃখে চিরসাথী। তাঁর দুর্বার আকর্ষণ এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। তাঁকে না ভেবে থাকা দায়। ভাবজগতের তিনিই এক, অদ্বিতীয়  রাজাধিরাজ।
সারস্বত পুরুষ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, পরমপুরুষ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তি, ও প্রাণপুরুষ বাবা নীরবে এসেছিলেন, আবার নীরবে চলে গেলেন। আসা-যাওয়ার এই নীরব ব্যবধানে তিনি রেখে গেলেন এক বিশাল বিচিত্র মানব সম্পদের অনন্ত সম্ভার। আলোর পথে চলার--আনন্দের পথে চলার নন্দনমার্গ--আনন্দমার্গ। শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার  বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন এক বিরল যুগপুরুষ। আনন্দমার্গ বিংশ শতাব্দীর  সর্বোজ্জ্বল সর্বানুস্যূত দর্শন। বিশ্বমানসের  প্রাণ-প্রদীপ আগামী হাজার হাজার বছর এর থেকে জ্বলে ওঠার রসদ পাবে। এক কথায়, আনন্দমার্গ এমন এক সর্বাঙ্গীন জীবনদর্শন যা একক মানুষের তথা বর্তমান সমাজ জীবনের সব সমস্যা সমাধানের স্পর্শমণি--মাইডাস্ টাচ।
আজকের পৃথিবীর সমস্যা কী--এ কথা জানবার জন্যে ব্যাপক গবেষণার দরকার নেই। একটু চোখ-কাণ খুলে রাখলেই তা অহরহঃ অনুভব করা যায়। সকলেই আমরা কম-বেশী ভুক্তভোগী--সমস্যা-পীড়িত। সমাজে সবার জন্যে আজও অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান নেই, শিক্ষা-চিকিৎসার সুব্যবস্থা নেই, মাথা গোঁজবার ঠাঁই নেই। মানবিক মূল্যবোধ নেই, প্রকৃত আধ্যাত্মিক চেতনা নেই। সুখ-স্বস্তি-শান্তি নেই, আনন্দলাভের পথ নেই। এই হাজার "নেই"য়ের নির্বিল্ব অন্ধকারে আনন্দমার্গ এক উজ্জ্বল স্বর্ণ-প্রদীপ--শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার নিশি-ভোরের সুস্মিত প্রভাতসূর্য। শ্রীপ্রভাতরঞ্জন  সরকার বিরচিত "প্রভাতসঙ্গীত" সেই অংশুমালীর কিরণমালার এক অত্যুজ্জ্বল কিরণ--যার উৎ সৃত জ্যোতিচ্ছটায়  বিশ্ব উদ্ভাসিত। প্রভাতসঙ্গীত শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের অমূল্য সৃষ্টিধারার এক অংশবিশেষ, এ কথা ঠিক। তবে এ কথাও ঠিক যে প্রভাতসঙ্গীতের বিপুল বিচিত্র সম্ভারেই লুকিয়ে রয়েছে সর্বকালের সর্বমানুষের সর্বাত্মক মানস-এষণার অনন্য দিব্যদ্যুতি ও অভ্রান্ত দেশনা।
আমি সঙ্গীতজ্ঞ নই, সঙ্গীতবোদ্ধাও নই। তবু প্রভাতসঙ্গীতের মর্মস্পর্শী ভাষা, সর্বস্পর্শী দার্শনিক প্রতীতি, অভিনব আধ্যাত্মিক চেতনা-বোধ বার বার আমার প্রাণ ছুঁয়েছে--মন-মাতানো মধুর সুর, সাবলীল ছন্দ-হিল্লোল হৃদয়ে দোলা দিয়েছে।। অন্তর থেকে বার বার অনুভব করেছি প্রভাতসঙ্গীত সম্পর্কে কিছু লেখা দরকার। প্রভাতসঙ্গীত সম্পর্কে এ যাবৎ  অনেকে অনেক কিছু লিখেছেন, ভবিষ্যতে লিখবেনও। তবুও এ যে না-বলা কথার অনন্ত স্বর্ণমঞ্জুষা। যত বলা হয় ততই বাকী থেকে যায়।
তোমার কথা ওগো প্রভু বলে কভু শেষ নাহি হয়
যতই বলি ততই দেখি যা বলা হয় তত বাকী রয়।  
(প্রভাতসঙ্গীত--৫১৫)


প্রভাতসঙ্গীত সবার জন্যে। অতি সাধারণ নিরক্ষর মানুষও যেমন প্রভাতসঙ্গীতের দিব্য ভাবরস আনন্দে উপভোগ করতে পারেন তেমনি অসাধারণ বিদগ্ধজনও এর থেকে গভীর মননের রসদ খুঁজে পাবেন। প্রভাতসঙ্গীতে তাই সহজ সরল প্রাণের ভাষার সঙ্গে কাব্য-সাহিত্যের অলঙ্কৃত ভাষার এক অপূর্ব মণিকাঞ্চন যোগ পরিলক্ষিত হয়। এমন কিছু দুরূহ অপ্রচলিত তৎসম  শব্দ বা গীতিকারের ব্যবহৃত নোতুন শব্দ চোখে পড়ে যা সবার সহজবোধ্য নয়।