প্রথাগত ছন্দশাস্ত্রে স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্ত এই তিন ছন্দের মাত্রা গণনায় যে রীতি নির্ধারণ করা হয়েছে তার অনেক ব্যতিক্রমও রয়েছে, যা অনেকেরই জানা নেই কারণ বইপুস্তকে এসব তথ্য বিরল। এ-লেখায় সংক্ষিপ্ত আকারে সেই ব্যতিক্রমগুলো সম্পর্কে একটি ধারণা তৈরির প্রয়াস রয়েছে:


অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কিছুকিছু শব্দ, যেমন ‘একতিল’, ’মানচিত্র’, ‘পণপ্রথা’, ‘প্রাণপণ’, ইত্যাদির ব্যবহারে মাত্রা গণনায় স্বাধীনতা ভোগ করা যায়। প্রয়োগ-কৌশলের ওপর ভিত্তি করে এগুলো কখনো তিনমাত্রা, কখনো চারমাত্রা হিসেবে গণ্য হয়, যদিও ‘একতিল’-এ ‘এক’, ‘মানচিত্র’-তে ‘মান’, ‘পণপ্রথা’-তে ‘পণ’ এবং ‘প্রাণপণ’-এ ‘প্রাণ’ এই বদ্ধাক্ষরগুলো শব্দের প্রথমে আছে বলে একমাত্রার হওয়ার কথা। ক্ষেত্রবিশেষে এগুলোকে দুইমাত্রা গণ্য করা যায়। তাৎক্ষণিকভাবে রচিত কিছু উদাহরণ দিচ্ছি: “তুমি কি একতিল তার বিরুদ্ধে গিয়েছো”-তে ‘একতিল’ তিনমাত্রার কিন্তু “একতিল নড়ে দেখো রেহাই পাবে না”-তে ‘একতিল’ চারমাত্রার; “মুখের মানচিত্র দেখে আমি তো অবাক”-এ ‘মানচিত্র’ তিনমাত্রার কিন্তু “এদেশের মানচিত্র আজ ঝঞ্ঝা-কবলিত”-তে ‘মানচিত্র’ চারমাত্রার; “বিয়েতে পণপ্রথা এক অভিশাপ যেন”-তে ‘পণপ্রথা’ তিনমাত্রার কিন্তু “ঘৃণ্য পণপ্রথা আজও সমাজের ক্ষত”-এ ‘পণপ্রথা’ চারমাত্রার; “প্রাণপণ চেষ্টায় শেষে সফল হয়েছি”-তে ‘প্রাণপণ’ তিনমাত্রার কিন্তু “আমরাও তো প্রাণপণ চেষ্টা করে বিফল হয়েছি”-তে ‘প্রাণপণ’ চারমাত্রার। অক্ষরবৃত্ত ছন্দে মাত্রা গণনায় এই স্বাধীনতার মূলে কাজ করছে যে-বিষয়টি তা হলো: এই শব্দগুলো একশব্দ হিসেবে গণ্য হলেও মূলত বদ্ধাক্ষররূপী প্রথম অংশটিও আলাদাভাবে অর্থপূর্ণ একটি শব্দ: ‘এক’, ‘মান’, ‘পণ’, ‘প্রাণ’। এছাড়াও, আরো কিছু শব্দ, যেমন ‘বাঙলার’, ‘সন্ধ্যায়’, ‘বরঞ্চ’, ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ হয়ে পরবর্তী অনেক বড় কবি কখনো তিনমাত্রা, কখনো চারমাত্রা হিসেবে ব্যবহার করেছেন।


স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত কবিতায়/গানের কবিতায় মাঝেমধ্যে তিন ও পাঁচমাত্রার পর্ব ব্যবহার নিয়ে অনেককেই দেখেছি প্রশ্নবিদ্ধ হতে এবং দ্বিধাদ্বন্দ্বে আক্রান্ত হতে। আগে বিক্ষিপ্তভাবে কারো কারো প্রশ্নের উত্তরে এ-বিষয়ে মতামত দিয়েছি। বিষয়টি নিয়ে কিছুটা বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করছি। স্বরবৃত্ত ছন্দে তিনমাত্রার ব্যবহার তখনই সিদ্ধ যখন শব্দটি উচ্চারণ করতে গিয়ে এমন সময় নেয় যা চারমাত্রার কোনো শব্দ উচ্চারণে যে সময় লাগে তার প্রায় সমান হয়। যেসব শব্দে প্রথম থেকে শুরু করে পরপর তিনটি বদ্ধাক্ষর (শব্দাংশ) রয়েছে,  যেমন ‘নৈমিত্তিক’, ‘দৈনন্দিন’ ‘ঐকান্তিক’, ‘নৈর্ব্যক্তিক’ ‘নিঃসন্তান’, ‘নিঃসম্বল’, ‘সম্বলহীন’, ‘ধনদৌলত’, ‘দেনদরবার’, দুঃসংবাদ,  ‘গদ্দীনসীন’ কিংবা পরপর অন্তত দু’টি বদ্ধাক্ষর রয়েছে, যেমন `ভুলভ্রান্তি', `দিকভ্রান্ত', `বিভ্রান্ত', `সম্ভ্রান্ত', `অক্লান্ত', `সম্ভাব্য', `আইনজ্ঞ', `নৈঃসঙ্গ', ‘দুষ্প্রাপ্য, ‘নিঃসঙ্গ’, ‘অত্যন্ত’, ‘কাজকর্ম’ ‘সংসর্গ’, ইত্যাদি শব্দ চারমাত্রার স্বরবৃত্তীয় পঙক্তিতে অনায়াসে ব্যবহার করা যায়। একটি কথা মনে রাখতে হবে এগুলো পঙক্তির ভেতরে ব্যবহার করাই শ্রেয়, যদিও প্রথমোক্ত শব্দগুলো স্বরবৃত্তীয় পঙক্তির প্রথমেও ব্যবহারযোগ্য। তবে, শেষোক্ত (মানে পরপর দুই বদ্ধাক্ষরবিশিষ্ট) শব্দগুলো পঙক্তির প্রথমে কিংবা শেষে ব্যবহার করলে কেউ এগুলোকে যথাক্রমে অতিপর্ব বা অপূর্ণপর্ব ভাবতে পারেন কারণ এগুলো মূলত তিন-মাত্রার শব্দ কিন্তু উচ্চারণে দীর্ঘ সময় নেয় বলেই চারমাত্রার মূল্য পায়। কয়েকটি উদাহরণ দিচ্ছি: “চর্চা করো নৈমিত্তিক ছন্দ শেখা সোজা”; “কোনোকিছু শিখতে হলে ঐকান্তিক চেষ্টা থাকা চাই”; “লোকটা এখন নিঃসঙ্গ চাইলে তুমি সঙ্গী হতে পারো”; “মুদ্রাগুলো দুষ্প্রাপ্য এখন কেবল যাদুঘরে পাবে”।  


এছাড়াও, প্রথম সিলেবল (শব্দাংশ)-এর পর কমা (,) বা বিস্ময় চিহ্ন (!) ব্যবহারের ফলেও তিনমাত্রার পর্ব স্বরবৃত্ত ছন্দে নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়। উদাহরণ: “না, কিছু/হয়নি আমার/এই তো ভালো/ আছি”-তে ‘না ‘-এর পর যে কমাটি বসেছে তার কারণে একটু যতি পড়ে এবং একমাত্রার উচ্চারণকাল ব্যয়িত হয়। ফলে ‘না, কিছু’ আঙুলের গণনায় তিনমাত্রার হলেও স্বরবৃত্ত ছন্দে সিদ্ধ। “হায়! তুমি/এ কী করলে”-তে ‘হায়’-এর পর বিস্ময়চিহ্ন আছে বলে একমাত্রার উচ্চারণকাল দাবি করে এবং এর ফলে “হায়! তুমি” আঙুলের গণনায় তিনমাত্রার হলেও স্বরবৃত্ত ছন্দে নির্বিঘ্নে ব্যবহার করা যায়।
স্বরবৃত্ত ছন্দে মাঝেমধ্যে ৫-মাত্রার পর্ব ব্যবহার নিয়ে এখন আর মাথাব্যথার কোনোই কারণ নেই কেননা রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ থেকে শুরু করে পরবর্তী কালের বহু বড় কবির উপর্যুপরি ব্যবহারে এটি সিদ্ধ হয়ে গেছে। বিশেষ করে গানের কবিতায় স্বরবৃত্তে ক্ষেত্রবিশেষে ৫-মাত্রার পর্ব মাধুর্য়মণ্ডিত সুরের জন্ম দেয়। কবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান তাঁর একটি বইতে এ-কথা বলতে গিয়ে তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি গানের সঙ্গে আমার একটি গানেরও উদাহরণ দিয়েছেন। খোন্দকার নূরুল আলমের সুরে গানটি গেয়েছেন শাকিলা জাফর। স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত এই গানটির আস্থাযীতে আমি কথিত তিনমাত্রা এবং ৫-মাত্রার পর্ব ব্যবহার করেছি এভাবে: “না, কিছু/হয়নি আমার/এই তো ভালো//আছি/(আমি) ইচ্ছে করেই/মেরে ফেলেছি/স্মৃতি নামের/দুরন্ত মৌ/মাছি।  ‘মাছি’ (মধ্যখণ্ডিত) ২-মাত্রার অপূর্ণপর্ব এবং ‘আমি’ দুই-মাত্রার অতিপর্ব। এখানে ‘না কিছু‘ ৩-মাত্রার পর্ব এবং ‘মেরে ফেলেছি’ ৫-মাত্রার পর্ব। বিশেষ করে ‘য়’-যুক্ত ৫-মাত্রার কিছু পর্ব এমনভাবে কবিতায়/গানের কবিতায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে যে, তা-ই প্রথায় পরিণত হয়ে গেছে। মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের একটি গান “মিছে হলো/সবই যে মোর/আঁধার ঘনায়/নয়নে//হারিয়ে গেছে/অনা্দরে/যা ছিলো এই/জীবনে”-তে ‘হারিয়ে গেছে‘ ৫-মাত্রার পর্ব হলেও এর ব্যবহার সিদ্ধ। একইভাবে ‘জড়িয়ে পড়ি’, ‘ভরিয়ে দেবো’-এর মতো বহু ৫-মাত্রার পর্ব স্বরবৃত্ত ছন্দে ব্যাকরণসিদ্ধ।


‘বেহেশত’ শব্দের উচ্চারণে ‘শ’ এবং ‘ত’ দুটোই হসন্তযুক্ত। ফলে, স্বরবৃত্তে দুইমাত্রার, অক্ষরবৃত্তে ও মাত্রাবৃত্তে তিনমাত্রার। বলা হয়ে থাকে মাত্রাবৃত্তে প্রতিটি বর্ণই একমাত্রা বলে গণ্য হয় কিন্তু এখানে এর ব্যতিক্রম দুই বর্ণের হসন্তযুক্ত উচ্চারণের কারণে। ‘প্রগলভ’ শব্দটির উচ্চারণ ‘প্রগোলোভো’। অতএব, চারটি স্পষ্ট মুক্তাক্ষরবিশিষ্ট বলে সব ছন্দেই এটি চারমাত্রার। ‘দোসত’ শব্দের উচ্চারণের দুটি রূপ রয়েছে--একটি উচ্চারণ ‘দোন্ত’-তে শেষ দু’টি বর্ণই হসন্তযুক্ত; আরেকটি উচ্চারণ ‘দোস্তো’-তে কেবল ‘স’ হসন্তযুক্ত কিন্তু ‘ত’ হসন্তমুক্ত। প্রথম ক্ষেত্রে এটি স্বরবৃত্তে একমাত্রার, অক্ষরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তে দুইমাত্রার। দ্বিতীয় উচ্চারণ (দোস্তো)-র ক্ষেত্রে স্বরবৃত্ত ও অক্ষরবৃত্তে দুইমাত্রার, মাত্রাবৃত্তে তিনমাত্রার। এখানেও মাত্রাবৃত্তে বর্ণের সংখ্যা গণ্য নয়। ‘হামদ’ এর উচ্চারণে ‘ম’ ‘দ’ দুটোই হসন্তযুক্ত। অতএব, স্বরবৃত্তে একমাত্রার, অক্ষরবৃত্তে দুই মাত্রার; মাত্রাবৃত্তেও দুইমাত্রার। এখানেও মাত্রাবৃত্তে বর্ণের সংখ্যা গণ্য নয়।