প্রভাতসঙ্গীত বিশ্বৈকতাবাদের অম্লান দ্যুতিতে সমুজ্জ্বল--প্রভাতসঙ্গীতের বিশাল কলেবর, ব্যাপক আয়োজন। ভাবজগতের সর্বস্তরে তার অনায়াস গতায়াত। প্রভাতসঙ্গীত মানুষের হৃদয়ের গান, প্রাণের গান। স্বপ্নের গান, কল্পনার গান। ভাবের গান, অভাবের গান। ভালো মানুষের গান, পাপী-তাপীর গান। প্রভাতসঙ্গীত সব মানুষের গান, সব দেশের গান। প্রভাতসঙ্গীত জীবনের গান।
এই গানে দ্বেষ-বিদ্বেষের বিভেদ বিষ নেই। জাত-পাতের উৎপাত নেই। শ্রেণী বিশেষের শ্রেষ্ঠত্ব,  মিথ্যা বর্ণ-গরিমা, ধর্মমতের অন্ধ মহিমা, ভাবজড়তার আস্ফালন--এ সব থেকে প্রভাতসঙ্গীত শত যোজন দূরে। কোন সঙ্গীতে কোথাও কোন সঙ্কীর্ণতা চোখে পড়ে না। কথায়-কাজে-চিন্তায়, দর্শনে-প্রবচনে, ভাব-ভাবনায় শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের বিশ্বৈকতাবাদীয় চিন্তাধারার সার্থক প্রতিফলন আমরা প্রভাতসঙ্গীতে স্পষ্ট দেখতে পাই--


আলোর এই যাত্রাপথে সবার আজ নিমন্ত্রণ আমি আহ্বান করি তাই
মহাজাগতিক দোলায় দুলিয়ে ধরা হল সুন্দর কোন ভেদাভেদ নাই।
এসো রেষারেষি ভুলি সবে মিলে বলি একই মোরা একই থাকিব গো
উঁচু নীচু নাই শাদা কালো নাই মোরা বিশ্বে সবাই ভাই ভাই।
একের দুঃখ সবার দুঃখ একের আকুতি সবার আকুতি
একেরই দোলায় দুলিছে বক্ষ অমিয় সাগরে একই গীতি
ভরে ভালোবাসা জাগাইয়া আশা ফোটাইয়া ভাষা সুমুখে চাই।
দিয়ে মিত্র অরাতি সবাকারে প্রীতি গেয়ে ক্ষমা গীতি এগিয়ে যাই। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা-- ৬৩৯)


আলোকতীর্থে চলি অতীতের গ্লানি ভুলি এগিয়ে চলাই জীবনের ব্রত মানি।
সবারে সঙ্গে ডাকি মমতার মধু মাখি সবাইকে নিয়ে সমাজ আমার জানি।
কল্যাণ যারা না চাহে ধরার, যারা বিষিয়ে দেয় সংসার
তাদেরও তরে আছে প্রীতিভার তাদেরও শুধরে আনি।
ঘৃণা করিব না কাকেও কখনও, না অবহেলা উপেক্ষা কোন
বাদ যেন নাহি যায় একজনও, সবে মিলে রথ টানি। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা-- ২০৭২)  


উঁচু নীচু ছোট বড় ভেদ না মানি এক প্রীতি ডোরে সবে বাঁধা তা জানি
একের আহ্বান সবাই শুণি, লক্ষ্য একই তুমি ধ্রুবতারা।
ব্যষ্টিস্বাতন্ত্র্য সমষ্টিবোধ, একেরই অনুধ্যান, পাপ প্রতিরোধ।
এদের সমন্বয়ে প্রীতি-ন্যগ্রোধ জাগাই, আনি ধরা পরে অমরা।। (প্রভাতসঙ্গীত সংখ্যা-- ৩৮২১)


উল্লিখিত সঙ্গী্তাংশের স্তবকগুলিতে গীতিকারের মানস এষণা স্পষ্টতই প্রতীয়মান। আলোর যাত্রাপথে তিনি সকলকে চলার আন্তরিক আহ্বান জানিয়েছেন। "উঁচু নীচু ছোট বড় ভেদ" তিনি মানেন না।  "রেষারেষি ভুলি" সবাই মিলে বলি "একই মোরা একই থাকিব গো"। মানুষ মাত্রে সবাই এক। কারণ "একের দুঃখ সবার দুঃখ একের আকুতি সবার আকুতি"। চাওয়া-পাওয়া, ব্যথা-বেদনার অনুভূতি সবারই এক।


এমনকি, "কল্যাণ যারা না চাহে ধরার, যারা বিষিয়ে দেয় সংসার"
"তাদেরও তরে আছে প্রীতিভার তাদেরও শুধরে আনি।" অর্থাৎ যারা অশুভ পথের যাত্রী, যারা আমাদের ক্ষতিও করে তাদেরও আমরা ভালোবাসি। তাদেরকেও শুধরে এনে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। প্রভাতসঙ্গীত তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সর্ব জনের হিতার্থে--সর্বজনের কল্যাণার্থে।


প্রভাতসঙ্গীতের আলোকে--


"মানুষ সবাই আপন
একই সূত্রে গাঁথা সবার হিয়া
সবাকার একই আয়োজন।"     (প্রভাতসঙ্গীত)


নিবিষ্টচিত্তে আজকের সমস্যাজর্জর সমাজপটে চোখ রাখলে দেখা যায়, সর্বসমস্যার মূল কারণ হল সমাজের নানান স্তরে নানান ধরণের সংকীর্ণ মতবাদের অন্ধ আগ্রাসন। বিবেক-বিবর্জিত মানস প্রবণতার মূঢ় আস্ফালন।  প্রভাতসঙ্গীতের দৃষ্টিতে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-জৈন-খৃষ্টান, ভারতীয়-অভারতীয়, স্ত্রী-পুরুষ, উচ্চ-নীচ, ছোট বড় সবার একই পরচিতি--সবাই মানুষ। এই কথাটা তত্ত্বে ও প্রয়োগভূমিতে যতদিন না আমরা প্রতিফলিত করতে পারব ততদিন এক সুষ্ঠ সার্বভৌম সমাজ গড়ে ওঠা মুশকিল। প্রভাতসঙ্গীতের গানে গানে বিশ্বৈকতাবাদের এই মর্মবাণী গাঁথা আছে। প্রভাতসঙ্গীতের তাই উদাত্ত আহ্বান হল--


"আজ এগিয়ে চল সকল মানুষ ভাই
আমন্ত্রণ সবারে জানাই
গেছে মানবতা ধূলোয় লুটিয়ে
দানব তারে দেয় যে গুঁড়িয়ে
এসো কাঁধ মিলিয়ে হাত মিলিয়ে
সুমুখ পানে চাই।
সকল মানুষ ভাই।"        (প্রভাতসঙ্গীত)


আজকের প্রভাতসঙ্গীত--


https://www.youtube.com/watch?v=MvlEG9QZHZY


https://www.youtube.com/watch?v=ujOWWcAyCGQ


    (ক্রমশঃ)